শরীয়তের আলোকে জন্মনিয়ন্ত্রণ
শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী (দাঃ বাঃ)
সর্বপ্রথম জন্মবিরতিকরণের
মৌলিক প্রচারণার হুকুম জানা আবশ্যক। এটা সংগত মনে হচ্ছে
যে সর্বপ্রথম জন্মবিরতিকরণে উপায়-উপকরণ ও ওষধাদীর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে,
যার উপর ভিত্তি করে জন্মবিরতিকরণের নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা
নিহিত।
জন্মবিরতিকরণের
ওষধাদীরঃ জন্মবিরতিকরণের স্বপক্ষের লোকজনের
কাছ থেকে উপস্থাপন করা হয়, তাতে বুঝা যায় যে এই নীতিমালা ও আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আর্থিক এবং
স্থান সংকট থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া। আর মানুষের স্বাভাবিক চাহিদা হচ্ছে,
সুখ-শান্তি ও
স্বাচ্ছন্দে যেন সে বসবাস করতে পারে। আর জন্মবিরতিকরণের
পক্ষাবলম্বনকারীরা মানবিক এই চাওয়া-পাওয়াকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ
করে তাদের জোরালো প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে যে, সুখী-সাচ্ছন্দ
জীবন যাপন করতে হলে জন্মবিরতিকরণের বিকল্প নেই। অবস্থাটা
এমন যে, নিজেই
রোগ নির্ণয়ের সাথে সাথে সে নিজেই নিজের চিকিৎসা
শুরু করলো। অথচ নিজের রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর
মতামত আস্থাশীল হতে পারে না। এর চেয়ে একটু
আগ বাড়িয়ে বলা যায় যে, অবস্থাটা এমন রোগ
আমি নিজেই তৈরি করেছি এবং এর ক্ষতিকর দিকগুলো আমি নিজেই নির্ণয় করব এবং তারপর এ থেকে
আমার আবিষ্কৃত পদ্ধতিতেই নিষ্কৃতি লাভ করব। অথচ রোগাক্রান্ত
হওয়া এবং তা থেকে নিষ্কৃতি লাভ; উভয়ের সম্পর্ক সন্দেহাতীতভাবে মানুষের ক্ষমতা ও আওতার বাইরে।
এটা কুদরতেরই ইচ্ছা যে, কে কখন
অসুস্থ হবে বা সুস্থ থাকবে।
আল্লাহ তা'আলা সম্পর্কে এরূপ
ধারণার কোনো অবকাশ নেই যে, তিনি অগণিত মানুষ
তৈরি করেছেন অথচ তাদের বসবাস ও আহার্যের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যদ্রব্যের সংস্থান করেননি। এ কারণেই মানুষের
নিজেদের খাদ্য ও বাসস্থান তাদের নিজেদেরই ব্যবস্থা করতে হবে।
এ ধরনের ভ্রান্ত ও মিথ্যা ধারণা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে করিমে
এরশাদ হচ্ছে যে- “তারা মূর্খদের ন্যায় আল্লাহর প্রতি
মিথ্যা ধারণা পোষণ করে”। মৌলিক
কথা হচ্ছে দুনিয়াবী রীতি-নীতি ও কলা-কৌশল দিয়ে আল্লাহ তায়ালার কুদরতের উপর ধারণা পোষণ করা চরম বোকামি ও মূর্খতাপূর্ণ। এটাতো
কোনো অবস্থাতেই হতে পারে না যে আল্লাহ তাআলা অগণিত মানুষ সৃষ্টি করলেন অথচ তাদের আহার্য
ও বাসস্থানের সংকুলান করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালার কুদরতি খাদ্য-শস্য ও জায়গা-জমির ভান্ডারে ঘাটতি দেখা দিল? আর এই কারণে যেহেতু
আল্লাহর ভান্ডারেই
ঘাটতি দেখা দিয়েছে, তাই এই সমস্যার সমাধান কল্পে তার সৃষ্টি মানুষকে দায়িত্ব নিতে
হচ্ছে (নাউজুবিল্লাহ)।
বাস্তবিকপক্ষে
আল্লাহ্ তা'আলা প্রত্যেক
কিছুরই অগণিত সীমাহীন মজুদ রয়েছে। কিন্তু যার জন্য
তিনি যতটুকু তাক্বদীরী ফায়সালায়ে নির্ধারণ করেন, তাকে ঠিক ততটুকুই দিয়ে থাকেন। এই সুনির্দিষ্ট
মাত্রার চেয়ে সামান্যতম কিছু কম-বেশি করার জন্য মানুষের সকল ক্ষমতাও
যে কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ কেমন নিরর্থক হবে। এ প্রসঙ্গে
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ
করেন, “সকল কিছুর
ধন ভান্ডার আমার কাছেই। এবং আমি সেখান
থেকে যার জন্য যে পরিমাণ নির্ধারণ করি সেই পরিমানই বিতরণ করে থাকি”।
অবশ্যই আল্লাহ
তায়ালা জ্বিন-ইনসান, জীব-জন্তু,পশু-পাখি,ফল-মূল,জায়গা-জমি ও খাদ্য-শস্যাদিসহ
দুনিয়ার যাবতীয় সকলকিছু প্রয়োজন অনুপাতে সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে
কোন কিছুই তার প্রয়োজন থেকে কম বেশ করে তৈরি করা হয়নি। যেমন ইরশাদ
হয়েছে, “আমি সবকিছুই নির্ধারিত মাত্রায় সৃষ্টি করেছি”। সুতরাং এটা কখনো হতে পারে না যে, মানুষ স্বীয় প্রচেষ্টা দ্বারা
আল্লাহর নির্ধারিত মাত্রায় কোন ধরনের হেরফের করতে পারে। অথবা এটাও
হতে পারে না যে আল্লাহ তা'আলা মানব সৃষ্টি করার পর তাদের প্রতি উদাসীন হয়ে গেলেন।
ইরশাদ হয়েছে, “আমার সৃষ্টির প্রতি আমি কখনোই উদাসীন নই”। তিনি প্রতিটি
মুহূর্তেই সমগ্র মানবজাতি, জিনজাতি, জীবজন্তু পক্ষীকূল, স্থল ও জলজ প্রাণীকুলের
সকলেরই আহার্যের ব্যবস্থা করে থাকেন। তিনি পূর্ব হতেই
যার জন্য যা প্রয়োজন ও নির্ধারণ করে রেখেছেন তা অবশ্যই পূর্ণ করে থাকেন। তিনি সকলের
সুনির্দিষ্ট বসবাস সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল। পাথরের
ভিতর যেসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীর বসবাস এবং মায়ের পেটে যদি বাচ্চা থাকে তিনি তাদেরকেও
নির্ধারিত মাত্রায় আহারের ব্যবস্থা করেন।
ইরশাদ হয়েছে- “আর পৃথিবীতে কোন
বিচরণশীল নেই তবে সবার জীবিকার
দায়িত্ব আল্লাহতালা নিয়েছেন। তিনি জানেন তারা
কোথায় থাকে এবং কোথায় সমাপিত হয়। সবকিছু এক সুবিন্যাস্ত কিতাবে রয়েছে”। (সূরা হুদ-৬)
তবে বিষয়টা নিয়ে
একটু গভীরভাবে চিন্তা করা হয় তাহলে সহজেই বুঝা যাবে যে জন্ম-মৃত্যু বাসস্থানকে জন্মনিয়ন্ত্রণের সাথে সম্পৃক্ত করা কতটাই না বোকামিপূর্ণ
অযৌক্তিক।
প্রশ্ন হচ্ছে ঊনবিংশ
শতাব্দীর আগে যখন জন্মনিয়ন্ত্রণের নীতিমালা সম্পর্কে কারো কোন জ্ঞান বা ধারনাই ছিল
না তখনো প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী বিনা বাধায় বংশবিস্তার অব্যাহত ছিল। সে সময়
মানুষের প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ ও শারীরিক সক্ষমতা ও সুস্থতা এবং গড় মৃত্যুর হার বর্তমান
সময়ের চেয়ে অনেক কম ছিল। অথচ আরাম-আয়েশ বা ভোগ্য
সামগ্রী ও খাদ্য সামগ্রী বর্তমানের তুলনায় ঐ সময় অনেক সীমিত ছিল। তাহলে
ওই সময় এত সংকীর্ণতার মধ্যেও মানুষ কিভাবে সুখে-স্বাচ্ছন্দে জীবন নির্বাহ
করতো?
জন্ম-মৃত্যুর ধারাবাহিকতা প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই চলে আসছে। এই স্বাভাবিক
প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করে জন্মনিয়ন্ত্রণের উদ্যোক্তারা ভবিষ্যতে কি পরিমান জন্ম-মৃত্যু হবে এবং তাদের খোরপোষ ও বাসস্থানের অংক কষা এখন থেকেই শুরু করে মানুষের
মধ্যে একটা ভীতিকর আবহ তৈরি করে থাকেন। অথচ এই
ধরনের হিসাব-নিকাশ আজ থেকে হাজার বছর পূর্বেও করা হতো। তখনকার
সময়ে মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে বর্তমান সময়ের মতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তো যে,যে হারে মানুষ
বাড়ছে,না জানি
এরা কিভাবে বাঁচবে? জন্মনিয়ন্ত্রণের
প্রবক্তারা এই ধরনের অহেতুক, অপ্রয়োজনীয় ও ইসলামের আক্বিদা-বিশ্বাস বিরোধী হিসাব-নিকাশ করে দুর্বল ঈমানদারদেরকে
বিভ্রান্ত করে এতে লিপ্ত করার প্রয়াস গ্রহণ করেন।
জন্মনিয়ন্ত্রণের
বৈধতা দানের লক্ষ্যে তারা আরও একটি দাবি পেশ করে থাকেন যে, দেশে সম্পদ ও পর্যাপ্ত
সুযোগ-সুবিধার সীমাবদ্ধতার মধ্যে
যদি অধিক পরিমাণে সন্তান জন্মদান করা হয় তবে তাদেরকে সঠিক উপায়ে
সুশিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা যাবে না। কারণ উন্নত
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সন্তানদেরকে গড়ে তোলার জন্য আজকাল অনেক টাকা-পয়সার প্রয়োজন। আর পরিবারের সদস্য
সংখ্যার আধিক্যতার কারণে এসব কিছু ভালোভাবে সামাল দেয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। এ ধরনের
যুক্তির মোকাবেলায় শুধু এটুকু বলব যে, আদব-কায়দা দিয়ে একজন সন্তানকে গড়ে
তোলার জন্য কখনো টাকা-পয়সার জন্য কেউ বাধাগ্রস্থ হয়েছে; এমন নয়। কারণ উন্নত আখলাক ও শিক্ষা-দীক্ষার অর্জনের জন্য নিজের একান্ত আগ্রহ ও পরিবেশ জরুরি, টাকা-পয়সা থাকা নয়। তাইতো দেখা যায়, অনেক কোটিপতি ধনীর
দুলালের পেছনে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করার পরও বকাটে, চোর- বাটপার ও সন্ত্রাসী হয়ে গড়ে ওঠে; যাদের কারণে গোটা
পরিবারের মুখে চুনকালি লাগে,সুনাম ও সুখ্যাতি মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়ে। আবার এমন
হাজার হাজার নিঃস্ব মানুষও রয়েছেন যাদের সন্তান খোদা
প্রদত্ত জ্ঞানের বদৌলতে এমন উন্নত চরিত্রের আদর্শ সুনাগরিক হয়ে
গড়ে ওঠেন যে, যাদের সুনাম ও সুখ্যাতি সারা
বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে।
তাছাড়া ইলমে নবুওয়াত
অর্জন করার জন্য যে উল্লেখযোগ্য কোন খরচাপাতির যে প্রয়োজন পড়ে না,তা তো আমরা সবাই
জানি। দ্বীনি মাদ্রাসার পক্ষ থেকে বিনা বেতনে
শিক্ষাদান এবং ছাত্রদের খোরপোষ ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। আর বাস্তবিক
শিক্ষা বলতে তো এসব দ্বীনি শিক্ষাকেই বুঝায়। কিন্তু
আজকাল মুসলমানদের নৈতিক অধঃপতনের কারণে এসব দ্বীনি শিক্ষার প্রতি তারা গুরুত্ব দিতে
চান না। সারকথা, সুশিক্ষিত ও আদর্শ
নাগরিক গড়ার জন্য অধিক সন্তান প্রতিবন্ধক নয়। জন্ম নিয়ন্ত্রণের
প্রয়োজনীয়তা ও অপরিহার্যতা বুঝানোর জন্য এটা কোন যুক্তি হতে পারে না।
আর যদি জন্মনিয়ন্ত্রণের
জন্য স্থান সংকট ও খাদ্য
ঘাটতির অজুহাত পেশ করে বলা হয় যে, এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। তখন তাদেরকে
প্রশ্ন করব যে, আপনার
গৃহপালিত ও অন্যান্য জীবজন্তুর মধ্যে জন্ম নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রয়োগ করছেন না কেন? অথচ গৃহপালিত জীবজন্তু
না কমিয়ে বরং এসবের বৃদ্ধির জন্য সরকারি বিভিন্ন প্রচার যন্ত্রের সাহায্যে জোরালো
প্রচারণা চালানো হয়। হিসাব করলে দেখা
যাবে, যে হারে
জীবজন্তুর বৃদ্ধি ঘটছে তাতে তাদের পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ খাদ্য যোগান দিতে হচ্ছে। দেখা যায়, ধনী ও ইংরেজি শিক্ষিত
অনেক পরিবারে কুকুর ও পশুপাখি কেবল শখের বশে পালন করা হয়। কিন্তু
এসব জীব-জন্তু থেকে কোন উপকারও অর্জিত হয় না। আর এসব
জন্তুর খাদ্য ও যত্নআত্মির পেছনে প্রতিদিন এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় যে, যার সমপরিমাণ মানুষের
পেছনে খরচ হয় না। কিন্তু এখানে তো
সরকারি মাধ্যম ও জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রবক্তারা কোন প্রতিবাদ করেন না। বরং এটাকে
তারা পারিবারিক আভিজাত্যের মাপকাঠি হিসেবে ধরে থাকেন। এবং এসব
জীবজন্তুর বংশবৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন গবেষণার কাজে আরো বিপুল অর্থ খরচ করা হচ্ছে। তাহলে
বুঝা গেল,জন্মনিয়ন্ত্রণের স্বপক্ষের প্রধান
যুক্তি খাদ্য ঘাটতি ও স্থান সংকট একটা মিথ্যে শ্লোগান ছাড়া আর কিছু নয়।
আর যদি বলা হয়
যে,মানবজাতি
উন্নতি ও উৎকর্ষতায় এখন আগের তুলনায় অনেক এগিয়েছে,তবে এটা কেন দেখা হয় না যে,আগের তুলনায় এখন
সম্পদ,বিভিন্ন
সামগ্রী,জীবিকা
নির্বাহ ও সম্পদ ব্যবস্থাপনায় অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে। দেখুন, পঞ্চাশ বছর পূর্বে
জমিনের উৎপাদন ক্ষমতা কতই না নিম্নমুখী ছিল? আর বর্তমানে নিত্য নতুন পদ্ধতি ও কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে
আগের তুলনায় জমিনে ফসলের উৎপাদন ক্ষমতা অনেক অনেক গুণ বেশি বৃদ্ধি হয়েছে।
এমনিভাবে বিগত
পঞ্চাশ বছরের তুলনায় সুখি ও সহজ জীবন ধারণের জন্য নিত্যনতুন আরো কলা-কৌশল, মিল-কারখানা আবিষ্কার হয়ে গেছে। পাশাপাশি
ভূগর্ভ থেকে নানা ধরনের মূল্যবান খনিজ সম্পদ তেল-গ্যাস,সোনা-দানা আর সমুদ্রগর্ভ থেকে আহরিত হচ্ছে মনি মুক্তা। নদী-নালা,খাল-বিল, সাগর-নদী, পাহাড-পর্বত ও বন-জঙ্গল সহ বিভিন্ন স্তর থেকে ফসল ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী আহরণের
ও সংগ্রহের অনেক পদ্ধতি চালু হয়েছে।
যেমনিভাবে সম্পদের
উৎপাদনে ও আহরণে দিন দিন উৎকর্ষতা লাভ করেছে, তেমনিভাবে স্বাভাবিক
মৃত্যু ছাড়া অন্যান্য দুর্ঘটনা ও দুর্যোগের কারণে মৃত্যুর হারও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। একথা অস্বীকার
করার কোনো সুযোগ নেই যে,
বর্তমান মানুষ দিন দিন যেসব নিত্যনতুন দুর্ঘটনা ও দুর্যোগের সম্মুখীন
হয়ে মৃত্যুবরণ করছে, পঞ্চাশ বছর পূর্বেও
মানুষকে এতকিছুর সম্মুখীন হতে হয়নি। যেমন ব্যাপকহারে
সড়ক দুর্ঘটনা, বিমান
দুর্ঘটনা, সামুদ্রিক
যানের দুর্ঘটনা, ইলেকট্রিক
দুর্ঘটনা এবং বিভিন্ন কলকারখানাসহ আরো নানা উপায়ে মৃত্যুঝুঁকি আগের তুলনায় এখন অনেক
বেড়ে গেছে। অথচ এসব দুর্ঘটনার কারণ তো পঞ্চাশ
বছর আগে ছিল না। বর্তমানে বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহে যেভাবে
লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত ও আহত হচ্ছে, দুইশত বছর পূর্বের অবস্থা দেখুন, তখন এর চেয়ে অনেক
বৃহৎ ও দীর্ঘ সময়ের
যুদ্ধেও এর সিকি ভাগ মানুষও নিহত আহত হয়নি। বর্তমানের
ইরাক, আফগানিস্তান
ও ফিলিস্তিনের প্রতি দেখুন। সেখানে প্রতিদিন
যে হারে মানুষ নিহত হচ্ছে ১০০ বছর আগে কী এমন হত্যাযজ্ঞ ঘটত?
এত অল্প সময়ে এরূপ গণহারে মানুষ মারা পড়ত?
পাশাপাশি বর্তমানে
প্রাকৃতিক দুর্যোগ আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। যেমন বিভিন্ন
স্থানে ভূমিধস, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে মানুষের
মৃত্যু হার অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন
ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সুনামি, আইলা, সিডরে কয়েক মিনিটের
মধ্যেই লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছে।
মূল কথা হচ্ছে, স্বাভাবিক মৃত্যুর
পাশাপাশি নিত্যনতুন বিভিন্ন দুর্ঘটনায় অগণিত মানুষ প্রাণ হারচ্ছে, জানা-অজানা নতুন নতুন অনেক রোগের প্রকোপও বাড়ছে আগের তুলনায়
। সম্প্রদায়ীক কলহ-বিবাদ ও রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ-বিগ্রহেও
মারা পড়ছে প্রতিদিন অগণিত নারী-পুরুষ। এর মধ্যে
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেও মানুষের বংশবিস্তার রোধ করা হচ্ছে। সুতরাং
এ পর্যায়ে হিসাব করে দেখা চাই যে, দিন দিন যে হারে জনসংখ্যায় ঘাটতি চলছে সে হারে যদি চলতে
থাকে,তবে আগামী
অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে দেখা যাবে সারাবিশ্বে বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ
জনসংখ্যার ঘাটতি শুরু হয়েছে।
জন্ম নিয়ন্ত্রণের ফলাফল
লোকালয় সম্প্রসারণ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির
গুরুত্ব ও আবশ্যকীয়তা সম্পর্কে ওই দেশগুলোর কাছে জিজ্ঞেস করুন, যুদ্ধবিগ্রহে বিধ্বস্ত হয়ে যারা নিজেদের ভূখণ্ডের উল্লেখযোগ্য
কোন অংশ হারিয়ে বসেছে । তারা আজ বসে বসে অনুতাপের হাত মলছে, আর বিলাপ করে বলছে, হায়! আমরা যদি জনসংখ্যা বৃদ্ধির পথে
অন্তরায় না হতাম, জনবসতি ও লোকালয় সম্প্রসারণে তাদের বাধা না দিয়ে
উৎসাহ যোগাতাম! সে দেশগুলো এখন জনসংখ্যা বৃদ্ধি
ও জনবসতি সম্প্রসারনের পথ তালাশ করছে। এ সম্পর্কে একটি দৈনিকে
প্রকাশিত সংবাদের প্রতি লক্ষ্য করুন। সেখানে লেখা হয়েছে যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং আমেরিকার জনসংখ্যা স্বল্পতা এখন একটি
গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে বিভিন্ন
দেশ থেকে আমদানি করে এখন লোকালয় ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপারে রীতিমতো প্রতিযোগিতা
চলছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
পর থেকে যদিও এ দেশগুলোতে জনসংখ্যা ও লোকবলের ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছিল, তা সত্ত্বেও সেখানে রাষ্ট্রীয় বিধান গর্ভপাত অবৈধ ছিল না। কিন্তু প্রথমতঃ সেখানে এখন গর্ভপাতকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পথে অন্তরায় ও জনবল বিলুপ্তির প্রধান কারণ হিসেবে ধরে নেয়া
হচ্ছে। দ্বিতীয়তঃ লোকজন বিয়ে-শাদী ও
পারিবারিক জীবনের পরিবর্তে বিয়ে বহির্ভূত যৌনজীবনে এ পরিমাণ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, তাতে নারীরা মা এবং পুরুষরা বাবা হওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। দেশের প্রতিটি নাগরিককে দেশের উন্নয়নকল্পে অধিকহারে শ্রম দেয়ার প্রতি উৎসাহ দেয়া
হচ্ছিল। যার ফলাফল এই দাঁড়ালো যে, দেশের সর্বত্র যুবক শ্রেণীর আনাগোনা কমে গিয়ে বুড়োদের সংখ্যা বেড়ে গেল। পারিবারিক জীবনের বিপরীতমুখী প্রথায়
প্রভাবিত হয়ে কোন কোন দেশে নারীদের সতীত্ব বিলিয়ে দেয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
অতএব, এখন হাঙ্গিরী ও পূর্ব জার্মানিতে ছোট ছোট শিশুদের স্বল্পতা অত্যন্ত
পরিষ্কারভাবে চোখে পড়ছে। আর সে দেশগুলোর বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই শিশু স্বল্পতা
দূর করার জন্য গভীর উদ্বিগ্নাবস্থা বিরাজ করছে। সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যা
তো এখন মারাত্মক হুমকির মুখে। পঞ্চাশ বছরের আগের তুলনায় এখন তাদের জনসংখ্যা অর্ধেকে
নেমে এসেছে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারিভাবে তারা নাগরিকদেরকে জনসংখ্যা
বৃদ্ধিতে মনোযোগী হওয়ার জন্য বিভিন্ন আকর্ষণীয় আর্থিক সুবিধা লাভের কথা বলা হচ্ছে। হাঙ্গিরীতে হাজার হাজার বসতিতে সন্তান ধারনের হার শতকরা ৩০ ভাগ থেকে ২৩ ভাগে নেমেছে। অপরদিকে গর্ভপাতের হার শতকরা ১৮ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জন্মনিয়ন্ত্রণের আরেকটি জঘন্যতম ক্ষতিকর
দিক হচ্ছে, এতে দেশ ও জাতিকে যুগশ্রেষ্ঠ ও জগদ্বরেণ্য মনীষী হতে বঞ্চিত হওয়া ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। বাবার কোন্ সন্তান বিদ্যা-বুদ্ধিতে যুগশ্রেষ্ঠ
হবে, তা তো পূর্ব থেকে বলা যায় না। মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ আজকের এই ছোট্ট শিশুটি ভবিষ্যতে কাঠামোগত, চিন্তাগত, কর্মদক্ষতা ও আধ্যাত্মিকতার
বিচারে কোন পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব হবেন, তা-তো আগে থেকেই নিশ্চিত করে
বলা যায় না। বার্থকন্ট্রোল নীতিমালার মাধ্যমে মানব অংকুরের যে বীজটিকে আজ নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে, তার সম্পর্কে কে নিশ্চয়তা দিবে বা দিতে পারে যে, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো সেই সন্তানটি বিদ্যা বুদ্ধি ও দক্ষাতায় কালের আবু হানিফা, বুখারী, ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ, গাযালী, রাযী, শাহজাহান , আলমগীর, কিংবা যুগের অতুলনীয় জাতীয় নেতা বা যোগ শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনেতা হবে না? হতে পারে আমাদের এহেন
বোকামির দরুন যোগ শ্রেষ্ঠ এমন বহু মনীষী হতে দেশ ও জাতি বঞ্চিত হয়েছে, যারা লাখো মানুষের ডুবু ডুবু জীবন তরী সফলতা ও উন্নতির কুলে
ভিড়িয়ে দিতে সক্ষম হতো। আর যাদের জীবনকে সুখী করার জন্য এদের মেরে ফেলা
হলো,
তাদের সবাই এর জন্য কোরবান হয়ে গেলেও তার হক খুব
কমই আদায় হত।
তাছাড়া মা-বাবার বেঁচে থাকা যে দু-তিনটি সন্তানের উপর
ভরসা করে অধিক সন্তান গ্রহণ নিষ্প্রয়োজন মনে করা হচ্ছে, তাদের জীবন সম্পর্কে কে গ্যারান্টি দিতে পারে যে, এই একজন বা দুইজন সন্তান বুড়ো কিংবা পূর্ণ জোয়ান হওয়া পর্যন্ত
নিত্যনতুন যাবতীয় প্রতিকূলতার সবকিছু পেরিয়ে নিরন্তর বেঁচে থাকবে? এমনও তো হতে পারে যে, মা-বাবার আশার গুড়ে বালি দিয়ে যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে ফয়সালাকৃত
হায়াত পুরা করে মা-বাবার সামনেই তারা মৃত্যুবরণ করবে। আর এমতাবস্তায় যদি মা-বাবা পূর্ব থেকেই স্থায়ীভাবে বন্ধ্যাত্ব গ্রহণ করেন তখন তাদের
অবস্থাটা কতই না হতাশাজনক হবে? সন্তানহীন তাদের
হৃদয়ের এই হাহাকার ও হতাশা কে পূরণ করবে?
জাতীয় পর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণের
প্রভাব
জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রবক্তারা তাদের
মতবাদ কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এমন সব স্থূল দুনিয়াবী উপকারিতার কথা বর্ণনা করেন যে, যাতে করে অনেক মৌলিক অপকারিতার প্রতি মানুষকে ভ্রুক্ষেপই করেন
না। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের কারণে উল্লেখিত ক্ষতিকর দিকগুলো
ছাড়াও জাতিগত সম্মিলিত অবস্থানের ব্যাপারে বেশকিছু পরিলক্ষিত হয়।
যার সারাংশ হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি বান্দার জীবনে দু পর্যায়ের হক নির্ধারণ
করেছেন। এক. হক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক। দুই. হক্কুল ইবাদ বা
বান্দার হক। মানুষের মধ্যে একে অপরের প্রতি যে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ রয়েছে, তাই হচ্ছে হক্কুল ইবাদ। যেমন- সন্তানের উপর মা বাবার এক ধরনের অধিকার বা দাবী রয়েছে। যথা- সন্তান আপন মা-বাবার সেবা যত্ন করবে, তাদের আদেশ-নিষেধ
মেনে চলবে, তাদের যেকোনো প্রয়োজনে সন্তান সাহায্যের হস্ত প্রসারিত
করবে,
বৃদ্ধাবস্থায় তাদের নিরাপত্তা, খোরপোষ, চিকিৎসা ও অন্য সব প্রয়োজনের
প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখবে। এমনিভাবে পিতা-মাতার প্রতিও সন্তানের কিছু দাবি ও
অধিকার রয়েছে। যেমন- পিতা-মাতা তাদেরকে শিশুকালে স্নেহের সাথে লালন-পালন করবে। আদব-কায়দা শিখাবে এবং সুশিক্ষা দিয়ে
একজন আদর্শ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে। উপযুক্ত হলে কন্যাদের
পাত্রস্থ করবে ইত্যাদি। এমনিভাবে ভাইয়ের প্রতি বোনের এবং বোনের প্রতি ভাইয়ের
হক রয়েছে। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর এবং স্ত্রীর প্রতি স্বামীর হক রয়েছে।
হক্কুল্লাহর ন্যায় হক্কুল ইবাদের গুরুত্বও
অপরিসীম। কারণ, পরকালীন বিচারের সময়
হক্কুল্লাহর ন্যায় হক্কুল ইবাদ সম্পর্কেও বান্দা জিজ্ঞাসিত হবে। যেমন, হাদীসে ইরশাদ হয়েছে- “সাবধান! তোমরা একে অপরের তত্ত্বাবধায়ক। এবং তোমরা সকলে পরস্পরের দায়িত্ব
ও কর্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে”।
প্রকাশ থাকে যে, এসব হক ও অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে মানুষ বিভিন্ন ধরনের কষ্ট
ও বাধার সম্মুখীন হয়। বিভিন্ন ধরনের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে। এসব মুসিবত ও কষ্টের মোকাবেলা করে ধৈর্য ও সুস্থিরতার সাথে নিজ নিজ সুনির্ধারিত কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য
শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এবং বান্দাকে এটাও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে, এসব দায়িত্ব পালনে যে সকল বাধা বিপত্তি ও মুসিবত আসে, তাও আল্লাহর বিশেষ হিকমত কৌশলের অধীনেই এসে থাকে। এমনই কঠিন পরিস্থিতিতে আল্লাহর যে সকল বান্দা বিভিন্ন ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে ধৈর্য ধারণ করে তার নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অটল থাকে এবং যেকোন
পরিস্থিতিতে আল্লাহর উপর রাজি ও সন্তুষ্ট থাকে, তাদেরকে স্থায়ী
ও অফুরন্ত সুখ-শান্তির জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া
হচ্ছে। ইরশাদ হচ্ছে-“এবং অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল
ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের”। (সূরা বাকারা ১৫৫ আয়াত)
এতে এটা স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান হয় যে, বিভিন্ন ধরনের গোত্র বা বংশে মানুষের সম্মিলিত ও জামাতবদ্ধ থাকার
মধ্যেও আল্লাহর হিকমত নিহিত রয়েছে। যাতে তারা উদ্ভূত বিভিন্ন সমস্যাকে
গোত্রীয় ভাবে মোকাবেলা করতে পারে এবং পরস্পর ঝগড়া বিবাদকে গোত্রীয় পর্যায়ে সমাধা করতে পারে। এবং তাদের নিরাপত্তা বিধানেও সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে
পারে। পারস্পরিক বিপদাপদে তারা যাতে দলবদ্ধভাবে একে অপরের সহযোগিতা
করতে পারে। এছাড়াও এতে আরো অনেক উপকারিতা নিহিত রয়েছে।
এ পর্যায়ে একান্ত মনোযোগের সাথে যদি
চিন্তা করা হয়, তবে সহজেই বুঝে আসবে যে, জন্মনিয়ন্ত্রণের কারণে সর্বাগ্রে মানুষের এই পারিবারিক ও সামাজিক
বন্ধন ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে ভেঙ্গে পড়ে। জন্মনিয়ন্ত্রণের ভাবনার ফলে মানুষের মধ্যে বৈষয়িক অতি স্বার্থপর চিন্তাভাবনা
ভর করে। যাতে তারা হক্কুল ইবাদ তথা বান্দার হক সম্পর্কে চরম উদাসীন হয়ে
যায়। আল্লাহর প্রতি আস্থা বিশ্বাস ও নির্ভরতায় ঘাটতি দেখা দেয়। পার্থিব আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসিতার প্রতি তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ হয়। মানুষ অনেকটা যান্ত্রিক
জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। মা-বাবা সন্তানের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বেখবর হয়ে পড়েন। তদ্রুপ সন্তান মা-বাবার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েন। ভাই-বোনের পারস্পরিক হৃদ্যতা কমে যায়। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কে অতিস্বার্থপর
চিন্তাভাবনা ভর করে। ক্রমান্বয়ে সমাজ বিশৃঙ্খলতার প্রতি
ধাবিত হয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ উঠে যায়। এসব অপকারিতার জন্য প্রধানত
দায়ী হচ্ছে জন্মবিরতিকরণ এর প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করতে গিয়ে অতি স্বার্থপরি চিন্তাভাবনা
তাদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া।
জন্মবিরতিকরণ এর আরেকটি
ক্ষতিকর দিক হচ্ছে,এতে বান্দা আল্লাহ ও পরকালমুখী হওয়ার পরিবর্তে চরম দুনিয়ামুখী হয়ে পড়ে। যেখানে শরীয়ত শিক্ষা দেয় যে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে
ভালো-মন্দ সহ সব বিষয়ে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল ও
ভরসা রাখতে হবে। আয় রোজগার সহায় সম্পদ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত
বিষয়। যার তকদিরে যা লিখা রয়েছে, সে যে কোন উপায়ে তা পাবেনেই। যেহেতু আল্লাহ সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, তাই সবার রিজিকের
ব্যবস্থাও তিনি করবেন। দুনিয়াবী নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে তিনি এক একজনকে দিয়ে এক এক কাজ করান। সমাজে ধনী-গরিবের পার্থক্য নির্ধারণ করেছেন; তাও মানুষের স্বার্থেই। অর্থাৎ ইসলামী শরীয়ত
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতি নির্ভর হতে শেখায়। অথচ জন্ম নিয়ন্ত্রণের
স্লোগানে মানুষের মনে এমন কুপ্রভাব তৈরি হয় যে, মানুষের অন্তরে আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল ও ভরসা ক্রমান্বয়ে কমে অতি দুনিয়ামুখী হয়ে পড়ে। মানুষ অতি বেশি ভবিষ্যৎমুখী হয়ে পড়ে। আগামী দিন কি খাব, কি পরিধান করব, এই চিন্তায় পেরেশান থাকে। এই যে মানুষের অতি স্বার্থপর মানসিকতা, যার ফলে দেখা যায়, মায়ের গর্ভে প্রাণের স্পন্দন চলে আসা সন্তানকে গর্ভপাত করে
হত্যা করতেও তাদের অন্তর কাঁপে না। যেমন ইরশাদ হচ্ছে-
“তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে
রিজিক সংকীর্ণতার ভয়ে হত্যা করো না। আমি তাদেরকে এবং তোমাদেরকে রিযিক দান
করি। অবশ্যই তাদেরকে (সন্তানদেরকে)
হত্যা করা মহাপাপ”। (সূরা বনী ইসরাঈল-৩১)। অন্যত্র আরো ইরশাদ হচ্ছে-
“নিশ্চয় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যারা নিজ সন্তান নির্বুদ্ধিতা বসতঃ কোন প্রমাণ ছাড়াই হত্যা
করেছে এবং আল্লাহ তাদেরকে যেসব দিয়েছিলেন, সে গুলোকে আল্লাহর
প্রতি ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে হারাম করে নিয়েছে। নিশ্চিতই তারা পথভ্রষ্ট
হয়েছে এবং সুপথগামী হয়নি”। (সূরা আনআম-১৪০)।
জন্মবিরতিকরণ এর দ্বারা এমন মানসিকতা
তৈরি হয় যে, তখন আয়-রোজগারের
উন্নতি ও অবনতিকে আল্লাহর পরিবর্তে স্বীয় প্রচেষ্টা ও যোগ্যতার উপরই নির্ভরশীল বলে ভাবতে শুরু করে। প্রকাশ থাকে যে, এ ধরনের চিন্তা ভাবনা ইসলামের সাথে প্রকাশ্য সাংঘর্ষিক। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তন কারী হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
নিজের উক্তি ও কর্ম দ্বারা এর প্রতি উৎসাহিত করে গেছেন যে, শরয়ী সীমার মধ্যে থেকে ওদিক থেকে বিয়ে করবে এবং অধিকহারে সন্তান
জন্ম দানের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করবে। যাতে করে কেয়ামতের দিন হযরত রসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় উম্মতের জনসংখ্যার আধিক্যতার উপর গর্ব করতে
পারেন। দ্বিতীয়তঃ মুসলমানদের সংখ্যাধিক্যের কারণে দুনিয়াতে ইনসাফ
ন্যায় প্রতিষ্ঠা সহজতর হবে। এবং কিয়ামতের পূর্বে দাজ্জালের মুকাবিলা করতে পারবে।
আইনি শরহে বুখারী গ্রন্থে রয়েছে মুলহিব
বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই
কারণেই আজল করতে নিষেধ করেছেন, যাতে কেয়ামতের দিন তিনি
অন্য উম্মতের তুলনায় নিজ উম্মতের আধিক্যতার উপর গর্ব করতে
পারেন। এবং মুসলমানদের সংখ্যাধিক্যের ফলে যাতে তারা সহজেই কাফিরদের
সাথে যুদ্ধে মোকাবেলা করতে পারে। এবং শেষ যুগে দাজ্জালকে তারা হত্যা
করবে। এজন্যই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের
বংশবৃদ্ধিকে পছন্দ করেছেন
জন্মনিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে
ক্ষতিকর আরেকটি দিক হচ্ছে, সরকারিভাবে ব্যাপক প্রচারণা এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ
সামগ্রির সহজলভ্যতার কারণে সমাজে যেনা ব্যভিচার মারাত্মক পর্যায়ে বেড়ে গেছে। স্কুল কলেজ ও ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীসহ
সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর দম্পতিদের মধ্যে বর্তমানে যেনা-ব্যভিচারের যেন সয়লাব
চলছে। পূর্বে গর্ভবতী হয়ে পড়ার ভয় হলেও এসব অপকর্মে ছেলেমেয়েরা লিপ্ত হতে ভয় পেত। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সহজলভ্যতার কারণে বর্তমানে সে ভয় পুরোটাই কেটে গেছে। এর ফলে সমাজে নৈতিক ও চারিত্রিক অধঃপতন মহামারীর রূপ নিয়েছে। আল্লাহতালা আমাদের সকলকে হেফাজত করুন।
জন্মনিয়ন্ত্রণের বিধান
এ পর্যন্ত জন্মনিয়ন্ত্রণের
ব্যক্তি,সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রভাব সম্পর্কে
আলোকপাত করা হয়েছে। নিম্নে জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রকৃতি এবং গূঢ়তত্ত্ব
সম্পর্কে আলোচনা করার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ।
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি যদি এমন হয়
যে, ইনজেকশন, আহার্য ঔষধ, অপারেশন দ্বারা পুরুষের যৌন শক্তি অক্ষুন্ন রেখে সন্তান প্রজনন
ও উৎপাদন ক্ষমতা নিঃশেষ করে দেওয়া হয় অথবা অপারেশনের মাধ্যমে মহিলার নালিকে জরায়ু থেকে বিচ্ছিন্ন করে, জরায়ুর মুখে কপার্টি ব্যবহার করে অথবা অন্য কোন উপায়ে তার বাচ্চা ধারণ ক্ষমতা
চিরতরে কিংবা সাময়িক সময়ের জন্য নষ্ট করে দেওয়া হয়, তাহলে তা নিজেকে বন্ধাকরন এর হুকুম এর অন্তর্ভুক্ত হবে, যা পরিষ্কার হারাম। এর সমর্থনে ফিকহে হানাফীর প্রমাণ্য কিতাব “দুররে মুখতারে” বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
বন্ধ্যাকরণ হারাম হওয়ার কারণ
বন্ধ্যাকরণ শরীয়তে এ জন্যে হারাম
করা হয়েছে যে, এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি মানবজাতির দৈহিক
পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষকে ক্রটিযুক্ত করা হয়। তদ্রুপ আল্লাহ তা'আলা মানুষের মাঝে বংশবৃদ্ধির
যে ক্ষমতা কুদরতীভাবে প্রদান করেছেন,তা নিঃশেষ করে
দেওয়া হয়।
বিবাহ-শাদীর রীতিনীতিকে জৈবিক চাহিদা বা যৌন মিলনের যে জোর আকর্ষণ প্রাকৃতিকভাবে
তৈরি করা হয়েছে,এর মূল উদ্দেশ্য হলো মানব বংশ প্রজনন ও বিস্তার। কিন্তু বন্ধ্যাকরণের দ্বারা নিয়তির এই মহৎ উদ্দেশ্যকে নস্যাৎ বা বাধাগ্রস্ত করা
হয়। সুতরাং প্রচলিত পদ্ধতিতে জন্মবিরতিকরণের মাধ্যমে ঐ উদ্দেশ্য
খর্বিত হয়। কাজেই উল্লেখিত যেকোনো জন্মবিরতিকর পদ্ধতি গ্রহণ করার ফলে সহবাসে
সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও বন্ধ্যাকরণের বিধানভুক্ত হবে। এছাড়াও যদি জন্মনিয়ন্ত্রণ
পদ্ধতি এমন হয় যে, কোন আহার্য ঔষধ বা ইনজেকশনের মাধ্যমে গর্ভাশয়ে বীর্য
স্থিতিতে বাধা প্রদান বা মহিলার সন্তান ধারণ ক্ষমতা কে সাময়িক রহিত করা হয় তাও বন্ধ্যাকরণের
আওতাভুক্ত হবে। যা ইমাম বুখারী রহ. নাজায়েজ ও মাকরুহ বলেছেন। সহীহ বুখারীতে তিনি এ
ব্যাপারে স্বতন্ত্র “বাবু মা ইয়াকরাহু মিনাত্তাবাত্তুলি
ওয়াল খিসাঈ” তথা জন্মবিরতি
পদ্ধতি ও বন্ধ্যাকরণ মাকরূহ নামে একটি অধ্যায় উল্লেখ করেছেন।
জন্মবিরতীকরণ সম্পর্কে
মোল্লা আলী কারি রহ. লিখেন- অর্থাৎ হাদিসে যে তাবাত্তুল
তথা জন্মবিরতিকণের নিষেধাজ্ঞা এসেছে,তা থেকে উদ্দেশ্য হচ্ছে,মহিলাদের থেকে
দূরে থাকা ও বিবাহ-শাদী বর্জন করা।
ইমাম বুখারী রহ. উল্লেখিত অধ্যায়ে যে হাদিস সমূহ বর্ণনা করেছেন, শেখানে আযল শব্দও এসেছে, যার সারমর্ম হচ্ছে তাবাত্তুল। সুতরাং এ থেকে বুঝা যায় যে, বিয়ের প্রকৃত উদ্দেশ্যই হচ্ছে সন্তান জন্মদান বা বংশবিস্তার। আর বিয়ের পর জন্মবিরতিকরণ বা বন্ধ্যাকরণের দ্বারা বিয়ের প্রকৃত উদ্দেশ্যেই
রহিত হয়ে যায়। কাজেই বিয়ের পর জন্মবিরতি বা বন্ধ্যাকরণ গ্রহণ মানে
বিয়ের পর স্ত্রীর কাছ থেকে দূরে থাকা বা বিবাহ শাদী বর্জন করার হুকুমের আওতায় চলে
আসো। কারণ শরীয়তে বিয়ে-শাদির
প্রথা বা প্রয়োজন কেবল যৌন চাহিদা পূরণের জন্য নির্ধারণ করেনি।
এ সম্পর্কে আরও কিছু হাদীস উল্লেখ
করা হল,
যদ্বারা অতি সহজে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিধান সম্পর্কে
অবগত হওয়া যাবে।
বুখারী শরীফে বর্ণিত প্রথম হাদিসঃ
হযরত সাঈদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস
রাযি. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমান ইবনে মাজউনকে
বন্ধ্যাকরণে নিষেধ করেছেন। যদি তিনি তাকে আদেশ দিতেন,তাহলে আমরা বন্ধ্যাকরণ পদ্ধতি গ্রহণ করতাম।
উল্লেখিত হাদীসের বর্ণনা মতে হযরত ওসমান ইবনে মাজউন রাযি. হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে বন্ধ্যাকরণের
অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
তার এ আবেদন প্রত্যাখ্যান করে তাকে এ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন। হযরত সাঈদ রাদিআল্লাহু আনহু বলেন যে, যদি হুযুর সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা নিষেধ না করতেন, তবে আমরা সাহাবীরা
এ পদ্ধতি অবশ্যই গ্রহণ করতাম। শুধু জন্মবিরতিকরণ নায়, তখন আমরা বন্ধ্যাকরনের
পদ্ধতিও গ্রহণ করতাম। যেহেতু বন্ধ্যাকরণ নাসারাদের প্রথা থেকে এসেছে, তাই হুজুর সাঃ এই প্রথা বর্জন করে
উম্মতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রতি উৎসাহিত করেছেন। যাতে মুসলমানগন কাফেরদের
উপর সহজে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, তাবাত্তুলের অনুমতি না দেওয়ার কারণে বন্ধ্যাকরণের অনুমতি প্রাপ্তির আর
কোন অবকাশ থাকলো না।
যদি ওসমান ইবনে মাজউন
(রাযি). কে রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বন্ধ্যাকরণের অনুমতি দিতেন তাহলে সাহাবীগণ আজল বা বন্ধ্যাকরণ কে বৈধ হিসেবে
গ্রহণ করতেন। তখন এই হুকুম কেয়ামত পর্যন্ত সকল উম্মতের জন্য প্রযোজ্য হয়ে
যেত। (উমদাতুল
কারী)
বুখারী শরীফে বর্ণিত দ্বিতীয় হাদীসঃ
হযরত আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক। অতএব, আমি আমার ব্যাপারে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা
করি। এমতাবস্থায় কোন নারীকে বিবাহ করার সংগতি ও আমার নেই। মূলত তিনি বন্ধ্যা হওয়ার অনুমতি চাচ্ছেন। আবু হুরাইরা রাযি. বলেন, এ সময় রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুক্ষণ
চুপ থাকলেন আমি পুনরায় একই প্রশ্ন করলাম, কিন্তু তিনি চুপ
থাকলেন।
অতঃপর পুনরায় প্রশ্ন করলে হযরত রাসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হে আবু হোরায়রা! যা তোমার পক্ষে তকদির ঘটার তা পূর্বেই লিখিত নির্ধারিত হয়ে গেছে। এতদসত্ত্বেও তোমার ইচ্ছে
হলে,
তুমি বন্ধ্যা হতে পারো অথবা এ ইচ্ছা পরিত্যাগ করতে
পারো।
উল্লেখিত হাদীসের শেষ বাক্য “ফাখতাসসা আলা যালিকা আওযির” এর ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী রহ. ব্যাখ্যা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাঃ
এর “ফাখতাসসা সূরাতান” এর অবস্থা তো এমনই যে, তিনি বন্ধ্যা হওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু এর অনুমতিদানের
গূঢ়তত্ত্ব আল্লাহ তাআলার সেই হুকুম এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যে, অর্থাৎ- যার ইচ্ছে হয় সেই ঈমান গ্রহণ করুক এবং যার ইচ্ছে হয় সে কুফরি গ্রহণ করুক। এখানে আল্লাহ তাআলার এরূপ আদেশের অর্থ কুফরি গ্রহণ করার অনুমতি দেয়া নয়, বরং এটি অনেকটা ধমকী স্বরুপ আদেশ ছিল। (উমদাতুল কারী- ৯/৩৬৩)।
তৃতীয় হাদিসঃ
হযরত জাবের (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,এক ব্যক্তি হযরত রাসুল (সা.) এর নিকট এসে বলল, হুযুর! আমার একজন দাসী আছে। সে আমার খেদমত করে এবং আমি তার সাথে যৌন মিলন করি। অথচ তার গর্ভধারণ আমি
অপছন্দ করি। হুযুর (সা.) বললেন ইচ্ছে করলে আযল কর, তবে যা তার তকদিরে নির্ধারিত আছে, তা হবেই। কিছুদিন পর সে লোক এসে বলল, হুযুর!
আমার বাঁদি গর্ভবতী হয়েছে। হুযুর (সা.) বললেন আমি তোমাকে পূর্বেই
বলেছি,
যা তার নির্ধারিত, তা হবেই। (মিশকাত-২৭৫)।
জন্ম বিরতিকরণ জায়েয বলার দাবীদাররা “আযিল ইন শিতা” দ্বারা তাদের দাবীর স্বপক্ষে জোরালো দলিল পেশ করে। কিন্তু হাদিস ব্যাখ্যাকারীগণ উল্লিখিত বাক্য দ্বারা আযলকে অযথা অপচয় ও অনুমতি না দেওয়া সাবস্ত্য করেছেন।
তার দৃষ্টান্ত এরূপ,কোন প্রতিষ্ঠানের বিশ্বস্ত ও অভিজ্ঞ কর্মচারী যদি তার মালিককে
বলে যে,আমি অমুক কোম্পানীতে নিয়োগ পেতে চাই। জবাবে যদি উক্ত মালিক তার আস্থাশীল প্রিয় এই কর্মচারীকে
বলেন,
“যাওয়া না যাওয়া তোমার ইচ্ছা,কিন্তু আমি তো আর তোমার মত কাউকে পাব না”। এতে কি উক্ত মালিকের
ওই কর্মচারীকে চলে যাওয়া অনুমতি দেওয়া বুঝায়? না,বরং সে এমন কৌশলী বাক্য ব্যবহার করেছেন যে, উক্ত কর্মচারী যেন আপনা-আপনিই
চলে যাওয়া থেকে বিরত থাকে।
বিশিষ্ট হাদীস বিশারদ
আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী (রহ.) মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল মুলহামে বলেন- রাসুল (সা.) এরশাদ,ইন শি’তা’ এর মর্মার্থ হচ্ছে,যদি তুমি ইচ্ছা করো, তাহলে গর্ভবতী
হতে দিও না। তবে এটা তোমার কোন উপকারে আসবেনা। কারণ, উক্ত বাঁদির জন্য যা নির্ধারণ
করা আছে ( সন্তান হওয়া না হওয়া),তা হবেই। ( ফাতহুল মুলহিম-৩/৫১৫
পৃষ্ঠা)।
চতুর্থ হাদীস মুসলিম শরীফ থেকে সংগৃহীতঃ
হুযুর (সা.) কে জিজ্ঞেস করা হলো, আযল সম্পর্কে। তিনি বললেন, আযল না করায় তোমাদের কোনো অসুবিধা নাই । তোমরা সাবধান হও, কারণ বিষয়টি তাকদীরের সাথে সম্পৃক্ত। মুহাম্মদ বিন শিরিন (রহ.) বলেছেন,রাসূলুল্লাহ্ (সা.)
এর আযল সম্পর্কে সায় না দেওয়াটা শরীয়তে নিষেধাজ্ঞার কাছাকাছি বোঝায়। আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী (রাহ.) বলেন, হযরত মুজাহিদ (রাহ.)
এর এক বর্ণনায় এসেছে যে, হুযুর (সা.) এর নিকট আযল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি বলেন, তোমরা উহা কেন করো? কিন্তু তিনি বলেননি যে,তোমরা উহা করো না। এর থেকে বোঝা যায় যে, তিনি স্পষ্ট নিষেধ
করেনি বরং ছেড়ে দেওয়া যে উত্তম, এ দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
কেননা আযল বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার ভয়েই করা হয়। সুতরাং তাতে কোনো ফায়দা
নেই। কেননা, কোন বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়া
যদি আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করে রাখেন, তবে আযল তাতে কোনো অবস্থাতেই প্রতিবন্ধক হতে পারবেনা। এ কারণেই কোন কোন সময় অবস্থা এমন হয় যে, জন্মবিরতিকারী সতর্ক থাকা সত্ত্বেও বীর্য
জরায়ুতে প্রবেশ করে এবং এতে সন্তান গর্ভধারন হয়ে যায়। অথচ আযলকারী বুঝতেই পারেন
না যে,
কি হতে যাচ্ছে। সুতরাং আল্লাহর বিধান
বা ফায়সালায় কোন পরিবর্তন হতে পারে না।
এই সকল হাদিস দ্বারা জানা গেল যে, আযল এর অনুমতি নাই, বরং অযথা ও ফায়দা বিহীন বলেই এটা সাব্যস্ত। তাই আযল গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। আযলের পক্ষে যেসব ভঙ্গুর
যুক্তি পেশ করা হয়, তা কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
জন্মবিরতিকরণের পক্ষের লোকজন জুরালোভাবে যে যুক্তিটি
উপস্থাপন করেন চায় তা হচ্ছে, সন্তান মাতৃদুগ্ধ পানকালীন সময়ে মা যদি পুনরায় গর্ভবতী হয়ে পড়েন, তবে বুকের দুধ কমে গিয়ে বাচ্চা কষ্ট পাবার আশঙ্খা থাকে অথবা
মায়ের স্বাস্থ্যহানী হওয়ার কারণে এসব কষ্ট সইতে পারবে না। তাদের এসব যুক্তি কে হাদিসে প্রত্যাখ্যান করা
হয়েছে। যেমন বর্ণনা করা হচ্ছে- সা’আদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাযি.)বর্ণনা
করেছেন যে, এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসুলের নিকট এসে বলল যে, আমি আমার স্ত্রীর
সাথে সহবাসের সময় আযল করি । রাসুল (সা.) তাকে বললেন, তুমি এমন কেন করো? লোকটি বলল, সন্তান এখনো স্ত্রীর বুকের দুধ পান করে। তাই স্ত্রী ও সন্তানের কল্যাণের কথা ভেবেই আমি এটা করি। অতঃপর নবী (সা.) বললেন, সন্তানের দুগ্ধ পানকালীন যদি উহা ক্ষতিকর হত, তাহলে রোম পারস্যদের অধিক ক্ষতি
হয়ে যেত। অথচ, তারা এমন কাজের (আযলের) সাথে জড়িত নয়। ( মুসলিম শরীফ সূত্রে মিশকাত-৩৭৫) ।
অন্যান্য সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে ফাতহুল মুলহামের লেখক বলেন- সন্তান জন্মদান থেকে বিরত থাকার প্রচেষ্টা কয়েকটি কারণেই গ্রহণ
করা হয়। তন্মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে এই যে, নিজের এমন স্ত্রী; যে অন্য কারো দাসী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। এমতাবস্থায় উক্ত স্ত্রী যদি তার মালিক
কর্তৃক গর্ভবতী হওয়ার আশঙ্কা থাকে, যাতে সন্তান অংশীদার
না হয়ে পড়ে। অথবা দুধ পানকারী বাচ্চার অসুস্থতার আশঙ্কা দেখা দিলে,যখন সহবাসকারীনী মহিলা উক্ত বাচ্চার দুধ পান করায়। অথবা বংশবৃদ্ধি বর্জন করার উদ্দেশ্যে, অর্থাৎ- পুরুষের আয় রোজগার কম হলে সে সন্তান প্রজনন থেকে বিমুখ হয়,যেন পরিবারের ভরণপোষণে তাকে কষ্টের সম্মুখীন হতে না হয়। অথচ আযল এসব সমস্যার সমাধানে
কার্যকর কোন উপকার করতে পারে না ।
গর্ভাবস্থায় দুধ
পান করায় কোন ক্ষতি নেই,
এ বিষয়ে মিশকাত শরীফে বর্ণিত হাদিস- হযরত জিদামাতা বিনতে ওহাব (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,কিছু লোকের
উপস্থিতিতে হযরত রাসূল (সা.) এর খেদমতে আমি হাজির হলাম। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি ইচ্ছা করেছি যে, গর্ভাবস্থায় দুধ পান করানো নিষেধ করব। কিন্তু
রোম ও পারস্যবাসীদের দেখলাম যে, তারা গর্ভাবস্থায় দুধ পান করায়। অথচ এতে তাদের
সন্তানদের তেমন কোন শারীরিক ক্ষতি হয় না। (এ কারণে আমি নিষেধাজ্ঞার
ইচ্ছা পরিত্যাগ করলাম)।
অতঃপর হুযুর (সা.) কে আযল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি
বললেন, এটি সূক্ষ্ম উপায়ে জ্যান্ত কবর দেয়ার মত, যে সম্পর্কে (পবিত্র
কুরআনে) বলা হয়েছে যে,“যখন জীবন্ত প্রোথিত কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হলো”। ( সূরা তাকভীর-৮-৯)
ফাতহুল মুলহিম গ্রন্থে এ হাদিসের ব্যাখ্যায়
বলা হয়েছে যে,আযলকে সূক্ষ্ম জীবন্ত কবর দেয়ার ন্যায় সাব্যস্ত
করা হয়েছে।কারণ,বীর্য আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার জন্য। সুতরাং বীর্যের অপচয় করে সন্তান নষ্ট করা, মূলতঃ সন্তানকে
জীবিত কবর দেয়ার মতই জঘন্য কাজ। তবে এ কথার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই যে, আযলের মাধ্যমে জন্মবিরতিকরণ সরাসরি সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়ার
তুলনায় কিছুটা নিম্নস্তরের কাজ। এজন্য আযলকে সূক্ষ্ম জীবন্ত প্রোথিত
করা বলা হয়েছে।
আমীরুল মু’মিনীন হযরত ওমর (রাযি.)
এর দরবারে একবার আযল এর আলোচনা হচ্ছিল। তখন এক ইহুদি ব্যক্তি আযল করাকে নিজ সন্তানকে সূক্ষ্ম উপায়ে জীবন্ত কবর দেয়ার সাথে তুলনা করে মত প্রকাশ
করলেন। এমতাবস্থায় হযরত আলী (রাযি.) উক্ত মজলিসে আগমন করলেন। তখন তিনি ঐ ব্যক্তির উক্তি
খন্ডন করে বললেন, শুধু আযল করাকে কোন অবস্থাতেই জীবন্ত সন্তান হত্যা
বলা যাবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত বীর্য সাত স্তর অতিক্রম না করে ।এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বললেন, প্রথমে তা মাটির নির্যাস
এবং তারপর বীর্যে রূপান্তরিত হয়। অতঃপর জমাট রক্ত, তারপর মাংসপিন্ডে পরিণত হয়। তারপর হাড় তৈরি হয়। এরপর সেই হাড্ডির উপর মাংস পরিয়ে দেয়া হয়। অতঃপর মানব সৃষ্টির চূড়ান্ত
পর্যায়ে সৃজন করা হয়। হযরত ওমর (রাযি.) বললেন,হে আলী, আপনি ঠিকই বলেছেন, আল্লাহ তাআলা আপনাকে
দীর্ঘজীবী করুন।
হাদিসে হযরত ওমর (রাযি.) আলী (রাযি.)এর মতামতকে পছন্দ করেছেন এবং তার শুভ কামনা করেছেন। এ থেকে এটা পরিস্কার বুঝা যায় যে, হযরত ওমর এবং হযরত
আলী (রাযি.) উক্ত ইহুদীর বক্তব্যকে
খন্ডন করে যে জাওয়াব দিয়েছেন, সকলেই
তা পছন্দ করেছেন। আযল সম্পর্কে হযরত ওমর (রাযি.) এর সাথে হযরত উসমান (রাযি.) এর যে মতামত ছিল, তা ফাতহুল মুলহিম গ্রন্থে হযরত ওমর (রাযি.) এর আযাদকৃত গোলাম হযরত নাফে
(রাযি.) এর উক্তিকে এভাবে বর্ণনা করেন- হযরত ওমর (রাযি.) তার কিছু সন্তানকে আযল করার কারণে প্রহার করেছিলেন। তাছাড়া হযরত ওমর ও উসমান (রাযি.)এর এরূপ একটি বর্ণনা আছে যে, তাঁরা উভয়ে আযলের
ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন।
সুতরাং হাদিসের আলোকে
উল্লেখিত সবিস্তার আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, জন্ম বিরতি বা
বন্ধ্যাকরনের নিষেধাজ্ঞা ও অপছন্দনীয়তা সম্পর্কে আমরা জানতে পারলাম। এবং জন্মবিরতিকরণের জন্য যেসব ওজর ও কারণ দেখানো হয়েছে, তাও উল্লিখিত আলোচনায় রদ করা হয়েছে। কিন্তু ফুক্বাহায়ে কেরাম
কিছু বাস্তবিক ওজরকে বিবেচনায় নিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জন্মবিরতিকরণ বা আযলের অনুমতি
দিয়েছেন।এমনকি গুরুতর ওজরের সম্মুখীন হলে গর্ভপাতের অনুমতিও আছে। কোন কোন ওজরের কারণে আযল
বা জন্মবিরতিকরণ বা বন্ধ্যাত্বকরণ করা যাবে,তার সবিস্তার বর্ণনা রদ্দুল মুহতার গ্রন্থে রয়েছে। উদাহরণতঃ কোন মহিলা শারীরিকভাবে এতটা
দুর্বল যে, গর্ভধারণ করা তার পক্ষে অসম্ভব পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, অথবা কষ্টকর দীর্ঘ ভ্রমণে থাকলে, অথবা এমন জায়গায় আছে, যেখানে সুস্থিরভাবে
অবস্থান করা অসম্ভব হয়, অথবা স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক টিকিয়ে থাকার ব্যাপারে গুরুতর সংকট দেখা দেয় বা
স্বামী নিজ স্ত্রীকে তালাকের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ইত্যাদি।যদি এ ধরনের কোনো ওজর না থাকে, তবে তা মাকরুহ ও নিন্দনীয় হবে। মাতহুল মুলহিম বর্ণিত
আছে,
উল্লিখিত দলিল প্রমাণ দ্বারা বুঝা যায় যে, আযল বা জন্মবিরতিকরণ মাকরুহ হবে, কিন্তু হারামের পর্যায়ভুক্ত হবে না। কাজেই আযল বা জন্মবিরতিকরণ
একটি অনুত্তম পন্থা।
আর যদি অধিক সন্তানের কারণে পরিবারে
অস্বচ্ছলতা বা অশান্তি দেখা দেয়ার আশঙ্কায় কেউ সন্তান জন্মবিরতিকরন পদ্ধতি গ্রহণ করে, তবে তাও ক্ষতিমুক্ত বলা যাবে না।যার বিস্তারিত বর্ণনা উপরে বলা হয়েছে। আযল বা জন্মবিরতিকরণের অন্যান্য ক্ষতিকর দিকসমূহ বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত আল্লামা
উসমানী (রহ.) বলেন- আযল বা জন্মবিরতিকরণ দ্বারা স্ত্রীদেরও কিছু স্বার্থহানি হয়। কারণ,এতে তারা সহবাসের পরিপূর্ণ তৃপ্তি অর্জন করতে পারে না। এমতাবস্থায়ও ফুকাহায়ে কেরামের মত হচ্ছে, একটি সমস্যাকে দূর করার জন্য আরেকটি সমস্যা তৈরি করা বৈধ হবে
না। আল-আশবাহ ওয়ান্নাযায়ের গ্রন্থে রয়েছে যে, একটি ক্ষতি থেকে
বাঁচার জন্য অন্য আরেকটি ক্ষতি তৈরি করা যাবে না। ( আল-আশবাহ্-১০৯)।
জন্মনিয়ন্ত্রণ না করায় যে ক্ষতির
সম্মুখীন হয়, তা নিরেট নিজস্ব ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের। তদ্রুপ জন্মনিয়ন্ত্রণ করলে ক্ষতি হলো ব্যাপক। এমতাবস্থায় ব্যক্তিগত
ক্ষতিকে জাতিগত ক্ষতির উপর প্রাধান্য দেওয়াকে ফুকাহায়ে কেরাম নিয়ম বহির্ভূত অযৌক্তিক
বলে মত প্রকাশ করেছেন।
আল-আশবাহ্ গ্রন্থে রয়েছে, একটি ব্যাপক ক্ষতিকে দূর করার জন্য অন্য একটি সুনির্দিষ্ট ক্ষতিকে
গ্রহণ করা যেতে পারে। এবং এই মতটি ফুকাহায়ে কেরামের ঐ উক্তির সাথে শর্তযুক্ত
যে, একটি ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য অন্য আরেকটি ক্ষতি গ্রহণ করা যাবে
না।
এবং যদি এটাও মেনে নেওয়া হয় যে, জন্মবিরতিকরণ বা আযলের ফলাফলে ক্ষতির পাশাপাশি উপকারও নিহিত
রয়েছে,তখনও ফুকাহায়ে কিরামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র ঐ
উপকারের দিকে লক্ষ্য করে ভুল হবে।
কেননা, আল-আশবাহ্ ওয়ান্নাযায়ের গ্রন্থে একটি ফিক্বহী মূলনীতি রয়েছে যে, উপকার অর্জন করার চেয়ে ক্ষতিকর বিষয় পরিহার করা অনেক উত্তম। যখন ক্ষতি ও উপকার একত্রিত হয়, তখন ক্ষতিকর বিষয়কে
আগে দূর করতে হবে। কেননা,শরীয়ত আদেশের চেয়ে নিষেধাজ্ঞাকে
অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ( আল-আশবাহ্-১১৪ পৃষ্ঠা)।
হযরত শাহ ওলিউল্লাহ (রহ.) বলেন, আযল নিষিদ্ধের সবচেয়ে বড় কারণ হল, তার উপকার পরস্পর বিরোধী। উদাহরণতঃ নিজ ব্যক্তিগত
স্বার্থে আযল করা হয় কিন্তু মানব প্রজন্মের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার দাবি হচ্ছে, আযল না করা। যাতে সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে বংশবিস্তার
অব্যাহত থাকে। সুতরাং আল্লাহ তাআলার শরয়ী ও বাস্তবিক বিধান অনুযায়ী, ব্যক্তিগত উপকারের পরিবর্তে সমষ্টিগত উপকারকে প্রাধান্য দিতে
হবে।
কাজেই সন্তান ভূমিষ্ঠ না হওয়া ব্যক্তিগত
উপকার। অপরদিকে বংশবৃদ্ধি জাতিগত উপকার। কেননা হুযুর (সা.) কেয়ামতের দিন গর্ব করবেন, এবং বংশ বিস্তারের কারণে কাফিরদের আধিক্যকে খর্ব করে দিবে। কাজেই এ পর্যায়ে ব্যক্তিগত প্রয়োজনকে পরিহার করে সামগ্রিক কল্যাণকেই প্রাধান্য
দিতে হবে।
সারকথা এই যে, মুহাদদ্দীস ও ফুক্বাহায়ে কেরামের বিভিন্ন কাওল দ্বারা এ কথা
প্রমাণ হয় যে, বিনা কারণে জন্মবিরতিকরণ নিষিদ্ধ। আর ওজরের যে ব্যাখ্যা ফুক্বাহায়ে কেরাম দিয়েছেন, তার মধ্যে যদি কোন ওজর পাওয়া যায়,তখন ব্যক্তিগতভাবে সাময়িক জন্মবিরতিকরণের অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু আজকাল যেসব দম্পতি
জন্মবিরতি গ্রহণ করার স্বপক্ষে আয়-রোজগার
বা বাড়ি-ঘরের সংকীর্ণতাকে ওজর হিসেবে উপস্থাপন করেন,তা কিন্তু গ্রহণযোগ্য ওজরের পর্যায়ভুক্ত নয়।
যখন জন্মবিরতিকরণকে রাষ্ট্রীয় বা জাতীয়
পর্যায়ে গ্রহণ করা হবে,তখন এই উল্লিখিত ক্ষতির উপস্থিতির কারণে কোন সুযোগ
দেওয়া হবে না। বরং কঠোরভাবে নিষেধ করা হবে। যা এ কারণে যে, যখন কোন মোবাহ্ কাজের বেলায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে একমত হওয়া যাবে। তখন তাকে জায়েয বা মোবাহ্
বলা হবে। আর যখন সেই মোবাহ্ বিষয়কে সামাজিকভাবে আবশ্যকীয় রূপে গ্রহণ করা হয়, তখন তার হুকুম পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) একজন মৃতের দাফন কার্য শেষে এক মহিলার
পক্ষ থেকে উপস্থাপিত দাওয়াত গ্রহণ করলেন। এটি একটি আকস্মিক ঘটনা
হওয়ার কারণে বৈধ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে কোন কোন শ্রেণীর মানুষ কারো মৃত্যুর পর প্রথম,দ্বিতীয় ও তৃতীয়
দিন দাওয়াত দিয়ে খানা খাওয়ানোর সাথে রাসূলে কারীম (সা.) এর উল্লিখিত অস্বাভাবিক ঘটনাকে দলিল
হিসেবে গ্রহণ করে। এ অবস্থায় তা আর বৈধ বলে পরিগণিত হবে না। যা ফুক্বাহায়ে কেরাম ব্যাখ্যা করে নিষিদ্ধ ও বিদআত বলেছেন।
এমনিভাবে কোন স্বাভাবিক বৈধ কাজ যদি
হঠাৎ করে বা কোন দিলের স্বাভাবিক চাহিদা অনুযায়ী কখনো ঘটে যায়, তখন তা বৈধ বা মোবাহ্ হিসেবেই পরিগণিত হবে। কিন্তু যখন এই মোবাহ্ বিষয়টি করা না করা নিয়ে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাবে, তখন তা নিষিদ্ধের অন্তর্ভুক্ত হবে। যেমন- আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম উটের গোস্ত খাওয়াকে এ জন্যই ছেড়ে দিয়েছিলেন যে, ইসলামে উটের গোস্ত আহার করা আর না করার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবে উটের গোস্ত আহার করা নিষিদ্ধ ছিল। এ জন্য যদি না খাওয়া হয়, তবে পূর্ববর্তী ধর্মের
প্রতি আমল করা বুঝায়। আর এতে ইসলামেরও কোন সমস্যা হয় না। তার এই মতামতকে ওহীর মাধ্যমে খন্ডন করা হয়। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেন, “হে মুমিনগণ, তোমরা ঐ সব সুস্বাদু বস্তু হারাম করোনা, যেগুলো আল্লাহতায়ালা তোমার জন্য হালাল করেছেন”। ( সূরা মায়েদা-৮৭)
।
এমনিভাবে কোন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি
যদি সাময়িক প্রয়োজনে গর্ভ স্থির না হওয়ার জন্য কোন পন্থা অবলম্বন করে, তাতে ফুক্বাহায়ে কেরাম অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে সাধারণত জন্মবিরতিকরণের যেসব কার্যক্রম জোরালোভাবে পরিচালিত
হচ্ছে,
শরীয়তের আলোকে এসব কিছু অবশ্যই নাজায়েয হবে। কেননা, এটা দ্বীনের সীমারেখা ও উদ্দেশ্যে অবৈধ অনুপ্রবেশের
শামিল। কারণ, শরীয়ত বিয়ে-শাদির মাধ্যমে সন্তান জন্মদান ও বংশবৃদ্ধির দ্বারা উম্মতের জনসংখ্যা
বৃদ্ধিকে পছন্দ করে। উম্মতের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্বারোপ করে যেমন ইরশাদ করা
হয়েছে যে, “তোমরা বিয়ে করো সুহৃদয় ও অধিক সন্তান জন্মদানকারী
নারীদেরকে। কেননা, আমি তোমাদের দ্বারা উম্মত বৃদ্ধির গর্ব কর”। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে
সহিহ্ বুঝ ও আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন
[সমাপ্ত]


No comments